সম্পাদকীয়

২ বর্ষ. ৪ সংখ্যা. আষাঢ় ১৪০৮. জুন ২০০১

বাংলা কবিতায় বিগত দশক ধ’রে অদ্ভূত মরীচিকা জমছে। একটি অপূর্ব ফাঁক আছে যার মাঝ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে সমস্ত ভালো লাগা, কাছে টানা, চেপে রাখা এবং ছুঁড়ে ফেলার মত সহজ সাধনা। কবিতা থেকে এ যেন সত্যিই কবিতার মুক্তি! আজকের তরুণদের কাছে এর কোনরূপ উপলব্ধির বালাই নেই; তার শব্দ-ক্ষেপণের ক্রমশঃ উত্তাপের কাছে- না চাহিলেও তারে পাওয়া যায়। উত্তরোত্তর আধুনিকতার কালো-ভ্রমর প্রপঞ্চে আজকের জসীমউদ্‌দীনরা (!) উপমায় মারাত্মক গড়েনহাটি। মানবিক উপসংহারে যদি ফিরতেই হয় তবে দিবস যাপনের এত কলাকৈবল্যতা কেন? কবিতার আপাতসিদ্ধ শেষ বলতে যা জানি তা যদি ‘মানুষ’ না হয় তবে আমাদের ভাবনায় চারুময় গন্ডগোল রয়েছে। এরূপ স্বমেহনে ক্রমশঃ বহির্লোকের সাথে অন্তর্লোকের যোগাযোগের খাঁটি পথটি রুদ্ধ হয়ে যায়। বলা যায়, নিরেট কোন উপলব্ধি অণুবর্ণনের কাল বিগত হয়েছে বহু আগেই, কবিতা কিংবা সাহিত্য চর্যার নিত্যদিনের বদলি পথে নায়ক আমি নিজে। কিন্তু এ কথা স্বীকার্য, একা একা যিনি নায়ক সাজেন তিনি এমন জেনেই সাজেন যে তিনি একা। কোন মঞ্চ-অভিনয়ের কথা হচ্ছে না, কারণ মঞ্চের নায়ক যদিও নাটকটির একমাত্র চরিত্র, অগুনতি মানুষের সচকিত চোখ সেখানে নিষ্ক্রীয় নয়। আমাদের সময় এবং যুগবৈশিষ্ট্যের ঘূর্নায়মান অণুচূর্ণের একটি মেঘখন্ড নয় অনিবার্য বৃষ্টিপাতই যৌক্তিক এবং আকাট। কেননা পৃথিবীতে কবির চেয়ে কবিতার প্রয়োজন যে অধিক। কবিতার অনুবর্তনেই কবির একক উজাগর।

দিনযাপনের সমস্ত সুখকর ক্লান্তি এবং বিব্রতকর স্বস্তির মাঝ হ’তে আমাদের কবিতারও ক্রমশঃ রূপ পাল্টে যাওয়া…। অস্থিচর্মসার ভাবনার কাগুজে উদ্‌গীরন হ’তে মুক্ত হোক জগতের তাবৎ সৃজনশীল কর্ম। যুগ-প্রবাহের কোন একক মূর্তির কাছে প্রণিপাত করতে সুখী নয় আজকের পৃথিবী। পৃথিবীর চাওয়ার ধরনটাকে বুঝতে হ’লে সামগ্রিক হওয়া চাই। আমাদের সমস্যা কী, রূদ্ধতা কোথায়, কেন আমরা বিগত কয়েক দশক ধ’রে সীমাহীন এক বিচ্ছিন্নতায় দগ্ধ। কেন কবিতা হ’তে কবিতার পাঠকের অন্তর্ধান ঘটছে- ভাবা দরকার। বলয়ের কথা বলতে এবং একই সাথে বলয়ের চারপাশে আর্তের মত ঘুরতে দেখেছি কবিতাকে। যে ভাবনা আমার নয়, যে শরীর আমার আত্মার উপর শোভা পায় না সেই দুর্যোগ কেন আমার চোখে রঙীন আলো জ্বালাবে?…. আমার নিজের সামগ্রিকতাকে আমি বিচ্ছিন্ন করতে পারি না।

কবিতাপত্র বের করছি আমরা। যুগবৈশিষ্ট্যের একটি নাজুক হাওয়াকে উস্‌কে দিতে চাই তা যতই দুরূহের যতই অসাধ্যের হোক। পক্ষাবলম্বনের পৌনঃপুনিক বিড়ম্বনার ভয় রেখেও কবিতা পত্রের নিজস্ব দাঁড়ানোর একটি পাটাতনতো থাকছেই। কাল-চক্রের ভাঁজে যা নিপুণ হবে, বিশ্বাস। 

কবিতাপত্র বের করছি আমরা। যুগবৈশিষ্ট্যের একটি নাজুক হাওয়াকে উস্‌কে দিতে চাই তা যতই দুরূহের যতই অসাধ্যের হোক। পক্ষাবলম্বনের পৌনঃপুনিক বিড়ম্বনার ভয় রেখেও কবিতা পত্রের নিজস্ব দাঁড়ানোর একটি পাটাতনতো থাকছেই। কাল-চক্রের ভাঁজে যা নিপুণ হবে, বিশ্বাস। আমাদের অন্তর্লোকের যাপনে সমস্ত ক্ষুধার এক মিলিত আয়াস এই পত্রিকা। যদি এমন ভাবা হয়- পৃথিবীতে একটি মানুষ বেঁচে থাকলেও কবিতা থাকবে তবে কবিতা সর্বাঙ্গীন ‘মানুষ’। আর এই মানুষের মাঝখানে ভিন্ন মানুষ নয় জগতের কোন প্রেয়যোগ্য কবি। আধুনিকতার (!) বাতচিত করলে বলা যায়- ক্রমশঃ মানববিচ্ছিন্ন আকার পেতে পেতে ক্ষিপ্ত চরকায় গতির রণন তুলে অজানায় ভাস্‌তে চাওয়া। এই ভাস্‌তে থাকার অচেনা আনন্দের কাছের অনেক বিপরীতে সমন্বিত, অকুঞ্চিত রূপে; নির্বিচারে বাকশৈলীর পৌনঃপুনিক শল্যচিকিৎসা হ’তে মুক্তি পাক কবিতা। আকাঙ্ক্ষা তাই। ভালবাসি তাদের- কবিতা নামের তিন অক্ষরে সীমাবদ্ধ নয় যারা। কবিতা পত্র তাই কবিতাই নয়, কথা কাগজও।

পাঠক আমাদের আলো দেবেন সামনের অন্ধকারে।

২ বর্ষ. ৪ সংখ্যা. আষাঢ় ১৪০৮. জুন ২০০১

সর্বশেষ প্রকাশিত

জনপ্রিয়

০টি মন্তব্য

আপনার মন্তব্য লিখুন

আপনার ই-মেইল ও মোবাইল নম্বর প্রকাশ করা হবে না। * চিহ্নিত ঘরগুলো অবশ্যই পুরণ করতে হবে।