কবি নামে জপমন্ত্র বৃথা

আলতাফ শেহাব

তোমার বয়ঃসন্ধির চোখ
প্রতিটি রাতকে টেনে টেনে প্রলম্বিত করে

মধ্যরাতে শোবার ঘরের
টাইমপিসের ঘন্টার কাঁটাটি খুলে
রেখে দাও বিছানার নীচে
তারপর কথার ঝুুড়ি নিয়ে
বসে যাও নৈঃশব্দের মুখোমুুখি

তখনো
বাঁশিওয়ালাদের গল্পঘরে সুরের আগুন
অথবা বলশালী জোছনা হ’তে
মেঘেরা অনেক দূরে… … …

তোমার চোখের ভেতর
অনন্ত সেই পথ চাওয়া’কে বলছি-
কবি নামে জপমন্ত্র বৃথা
সন্ধ্যা এলে দীঘির জলেই
পাটাতনের পাঁজর ভাঙ্গি

জল-জোছনার ঘ্রাণ নজরবন্দি

ছায়াপথের নাভী হ’তে খসে যাওয়া নক্ষত্রটি
মেঘে ভেসে ভেসে অন্ধকার হেটে এসে
কোমল কোন এক কৃষ্ণবর্ণ ঘাটে
ব্যথায় নতজানু প্রথম শব্দচিহ্ন খুঁজে পেলেন।

বহু নদীর জরায়ু এ ঘাটে এসে
বৃদ্ধ গোলাপের মতো বিবর্ণ হ’য়ে যায়,
ফলবতী ফসলের মাঠ এ ঘাটের জলে
অনন্তকাল প্রসবোন্মুখ র’য়ে যায়।

ঘাট ছাড়িয়ে দাবানল মুহুর্ত আগে মোহনায়;
ছাই-আগুনের সঙ্গমে নদীকুল হৃদ্য হোক
জল-জোছনার ঘ্রাণ ততক্ষণ নজরবন্দি।

দুই.
আদরে আহ্লাদে আমি তোর পোষা
এ সত্য জানা বলেই
তোর মান আর প্লাবন নিয়ে
নদীবর্তী হই আপোষে।

বেহুলার বিষমন্তর

একুশ আমার সব ক্লান্তি তোমার চোখে
স্বপ্ন দেখতে গিয়ে বার বার ক্লান্ত চোখ মনে আসে

রাতের যৌবন ক্লান্তির পথে
সাপেরা জোছনায় ছুঁড়ে দেয় বেহুলার বিষমন্তর
একুশের আগুনে নক্ষত্রের মতো পোড়ে
বিমর্ষ গোধূলীর দলছুট এইসব মিথুন রেখা
এ সময়ের ঘুমবিষ বিকেলের কষ্ট
শীতপাখিদের ডানায় তীর্থযাত্রী

রাতের ক্লান্তি শেষে
আবার আঁধার মন্ত্র
শত্রুরা আমাকে শত্রু ভাবে না

দুই.
পৌষের হিমে হাঁটুজলে একা বক
পুঁটিদের ঝাঁকে ঠোঁটের আশ্রয় খোঁজে।
ঘাসের ডানায় শিশিরে’র প্রণয় নৃত্য
জোড় শালিকের চোখে কিশোরীর আকাঙ্ক্ষার বীজ-
ক্লান্ত রাতের ঘুমকে প্রলুব্ধ করে … … …

সর্পচূড়ায় উড়ে যাও ফড়িং … … …
তোমার ঊর্বশী ডানায় বেঁধে দিলাম
বখাটে ঘুঁড়ির নীল সুতো।

শ্যাম চরণে মোর মনসাদেবী’র বাস,
মনসা’র জলকেলি অথবা মৈথুনের সময়
চপলডাঙ্গা’র নবান্নের খবর দিও-
এ নবান্নে ফসল হয়েছে বেসুমার।
চাষীদের চোখের জলে
পুষ্ট রমণীর কাম-স্নানের ক্ষুধা,
চপলডাঙ্গা’র শস্যে আর বীজ হয় না।

বীজ না থাকার দায়ে চিতার মুখাগ্নি অবরুদ্ধ।

সম্ভাব্য বীজ

দেয়ালের বনসাই অশ্বত্থটি অনেক মিছিল দেখেছে। মিছিল শেষে অনেক ক্লান্তি; উচ্ছাস নিয়ে চায়ের কাপে প্রশান্তি অথবা লাল-নীল নানা রঙা নোট নিয়ে ঘরে ফেরার উৎফুল্ল চোখ দেখেছে। কিন্তু কোন কালের বা সময়েরই সাক্ষী সে নয়। অশ্বত্থ বনসাই ঘিরে আড্ডা এবং আড্ডাচক্র কেন্দ্রীক চায়ের দোকান- এর আশেপাশে হাজারো জলসার পোষ্টার; এসবে দোকানীর আগ্রহ খুব কমই থাকে। খুব সামান্য কিছু ক্রেতার লেনদেন মনে রাখে। আর মনে থাকে লাল রঙে’র কিছু পোষ্টার অক্ষত রাখার আকাঙ্ক্ষা।

অপেক্ষায় থাকে
তার আকাঙ্ক্ষার বীজ হ’তে কবে জন্ম নেবে
হাজারো মিছিল; হাজারো শ্লোগান।

জরায়ু এবার একটু জোরে শ্বাস নাও

বাতাসে সহস্র শুক্রানু ভাসে
জরায়ু এবার একটু জোরে জোরে শ্বাস নাও।
সম্ভোগের বিষমন্ত্র, সঙ্গমের বীজমন্ত্র
জপেছি বহু কাল
সম্ভোগে নয়, সঙ্গমে নয়।
কানাকানি ফিসফাসে পিছু হটেছি কোটি ক্রোশ
এবার আর গুঞ্জনে নয় গর্জনে।
আমাদের নদী আছে, জলও আছে
নাইতে নামবো তীরের মধ্যবর্তী দৈর্ঘ্য মেপে।

পৃথিবীর এইসব ধূলোময় পথে পথে
বিশ্বাসীদের বীর্য হ’তে খসে
সহস্র শুক্রানু আজ স্বর্গমুখী নয়
জরায়ু অভিমুখে কপাল ঠেকিয়ে … …
জরায়ু এবার একটু জোরে জোরে শ্বাস নাও।

শিশিরে কতটুকু মজে বাতাসের খরা?

বিনম্র শ্রদ্ধায় নূয়ে যাওয়া ঘাস পাতাটি জানে
কতটুকু জল হ’লে মাথা নিচু হয়;
রোদের দুপুর না জানুক সে কথা।
ফড়িং আর পাখিরা জানে
কোন পাতা আর ডালটি
ধারণ করার আনন্দে
মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে জানে।

স্নানঘরে ঝর্ণাকল খুলে
নগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকুন
অথবা জলপায়ে ঘরময় হাঁটুন।
এ কথা নিশ্চিন্তমনে ভুলে যান
জল শুকোতে কতক্ষণ!

মাটি আর ঘামের গন্ধ মেখে
বুকের ঠিক মাঝখানটায় চুমুক লাগান
আবিস্কার করুন … …
শিশিরে কতটুকু মজে বাতাসের খরা!

ক’টি অমীমাংসিত দৃশ্য

[ক’টি নদী অনেক….অনেকদূর হেঁটে এসে, একই বিন্দুতে শেষ হ’য়ে যাবার স্বপ্ন দেখে। পথে পথে বহুবার জলের ভাষা বদলায়, শরীরও বদলায়, বদলে যায় অনেক কিছু। ঘুমবিন্দুতে এসে দেখা যায়- কারো শেষতো কারো শুরু … …। তারপর কিছু দৃশ্য সাথে নিয়ে ‘শেষ’ শুরুর পথে; ‘শুরু’ শেষের পথে হেঁটে চলে … …]

দৃশ্য- এক.
আকাঙ্ক্ষার সহস্র যোনীমুখে সম্ভোগ তৃষ্ণা
রতিলিপ্সু ঠোঁটে ধুতরার বিষ ঢেলে
মৃত্যুবীজ নিয়ে শুশ্রুষার দ্বারে ফিরে যাই

দৃশ্য- দুই.
ঘ্রাণতরী ডুবুডুবু জ্যোস্নার গুহামুখে
উৎসের বেদীমূলে তলিয়ে যায় পরজীবী কেচ্ছা

দৃশ্য- তিন.
গৃহস্থের মাঝ-উঠানের নবান্নের খুঁটি
মহাকালের গতির শেকলে বন্দি

দৃশ্য- চার.
কাঁটা গাছের বাগান অথবা সোনালী ধান
এসবের দামে কিনে নিলাম রোদের উঠান

দৃশ্য- পাঁচ.
কথার ব্যথা সাঁতরে বেড়ায়
দেবী তোমার আগল খোল
এই নদীতে ডুবি চলো……..

৫ বর্ষ. ৭ সংখ্যা. ফাল্গুন ১৪১০. ফেব্রুয়ারি ২০০৪

০টি মন্তব্য

আপনার মন্তব্য লিখুন

আপনার ই-মেইল ও মোবাইল নম্বর প্রকাশ করা হবে না। * চিহ্নিত ঘরগুলো অবশ্যই পুরণ করতে হবে।